রেখা হাতের তালু মেলে ধরল। আঙুলকে কলমের মতো বানিয়ে ইশারা করল কিছু লেখার।
—ওমা, এই মেয়ে যে অটোগ্রাফ চায়!
দুই পাশে মাথা নেড়ে সায় দিল। কলম খুলে রেখার হাতে নিজের নাম লিখে দিতেই সেকি খুশি সে! চোখেমুখে আনন্দের ছটা। বিশাল কিছু একটা পাওয়ার উল্লাস সেখানে। ডায়াসের পাশে দাঁড়ানো বন্ধুদের হাতটা নাড়িয়ে দেখাতে লাগল সে।
—তুমি কোত্থেকে এসেছ?
প্রশ্নটা শুনে গলার সঙ্গে ঝোলানো পরিচয়পত্র সামনে মেলে ধরল। সেখানে তার নাম লেখা— তাসলিমা খাতুন রেখা। বয়স ৯। ঠিকানা—কুষ্টিয়া। রেখা কথা বলতে পারে না। শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী সে। মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের মাঠের পশ্চিমদিকের কিছু অংশ শামিয়ানা দিয়ে ঘেরা। অতিথিদের বসার জায়গা সেটা। সেখানেই রেখার অভিভাবিকা জানালেন—‘ও কথা বলতে পারে না। শুনতেও পারে না। কিন্তু অনেক বুদ্ধি ওর। সামান্য উশারায় অনেক কিছু বুঝতে পারে। এখানে এই প্রতিযোগিতায় সে দুটো পুরস্কার জিতেছে। আমার বিশ্বাস, সহযোগিতা ও সামান্য সমর্থন পেলে সে অনেক বড় কিছু করতে পারবে।’
ঠিক একই বিশ্বাস ঝরল বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেটার হাফিজুর রহমান বুলেটের গলায়ও—‘যে কোনো লক্ষ্য অর্জনে বয়স ও প্রতিবন্ধিতা কোনো বাধা নয়। চাই অনুপ্রেরণা, চাই সহযোগিতা। আমরা মানুষের কাছ থেকে শুধু সামান্য এই দুটো বিষয় চাই। এই অনুপ্রেরণা এবং সঙ্গে সহযোগিতা পেলে যে কোনো প্রতিবন্ধী মানুষ উন্নয়নের মূলধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে দেশের আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।’
ছেলেদের বল নিক্ষেপে প্রথম স্থান পাওয়া শফিকুল হুইল চেয়ারে বসে রঙিন কাগজে মোড়ানো পুরস্কারের প্যাকেট হাতে বসেছিল। কাছে যেতেই কথার ঝাঁপি খুলে দিল ১৭ বছর বয়সী শফিকুল—‘জানেন, আমি আগেরদিনও একটা পুরস্কার জিতেছি। আমি একদিন আরও বড় ফার্স্ট দিব।’ শফিকুল নিজ পায়ে হাঁটতে পারে না। যখন থেকে হুঁশ হয়েছে সঙ্গী তার হুইল চেয়ার। জন্মই নিয়েছে সে পোলিও রোগ নিয়ে। কোমরের নিচ থেকে দুটো পা অসাড় তার। শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ বেশ সবল। কিন্তু দুটো পা-ই অস্বাভাবিক রকম চিকন। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন—শফিকুল কোনোদিন নিজের পায়ে হাঁটতে পারবে না। কঠিন সত্যটা শফিকুল নিজেও জানে। তবে দুঃখ পায় যখন কেউ তার সঙ্গে তার এই ‘অসুখ’ নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করে। শফিকুল বলছিল—‘গ্রামে অনেকে এসব নিয়ে আমার সঙ্গে শয়তানি করত। উল্লা-পাল্টা কথা বলত। তখন আমার অনেক খারাপ লাগত। মাঝে মাঝে কাঁদতাম। কিন্তু কাউকে চোখের পানি দেখাতাম না। তবে সাভারের সিআরপিতে আসার পর থেকে আমি নতুনভাবে বাঁচতে শিখেছি। এখানে আমি ইলেকট্রিকের ও মোবাইল ফোন মেরামতের কাজ শিখছি।’ সামনের দিনে নিজের স্বপ্নের কথা জানাচ্ছিল শফিকুল—‘এই কাজ শিখে আমি একটা দোকান দিতে চাই। সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।’
শফিকুলের শেষের কথায় জেদ মিলল। নিজেকে প্রমাণ করার জেদ। অদৃশ্য কারো সঙ্গে জেতার একটা জেদ যেন!
কুষ্টিয়ার কাকলির বয়স যখন চার তখন থেকেই সে নানীর কাছে। বাবা-মা নিতে এলেও কাকলি নানীর বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে। যেতে চায় না। কাকলিও শ্রবণ এবং বাকপ্রতিবন্দ্বী। কিন্তু দারুণ গুণবতী। সে কথাই শোনাচ্ছিলেন তার নানী লিলি বেগম—‘সেলাইয়ের কাজ, বাসার কাজ, রান্নাবান্না—সব কাজ পারে কাকলি। অনেক কষ্ট করে ওকে মানুষ করেছি। ওর বয়স এখন ষোল। আমি ওকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার জীবন আর কতদিন। আমি চাই ও নিজে চলা শিখুক।’ কুষ্টিয়ার প্রতিবন্ধী স্কুলের ভালছাত্রী কাকলি খেলাধুলায়ও চোস্ত। এবারের প্রতিযোগিতায় দৌড়ে প্রথম হয়েছে সে। সামনের অনাগত ‘জীবনের দৌড়েও’ কাকলি এখন সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। আর সেই লড়াইয়ে জিততে করুণা বা দয়া-দাক্ষিণ্য নয়, চায় সে সামান্য সহযোগিতা-সহমর্মিতা।
রেখা, বুলেট, শফিকুল ও কাকলি—সমাজ এদের সবাইকে চেনে প্রতিবন্ধী হিসেবে। এই প্রতিবন্ধীরা যে ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশের হয়ে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে, তারই একটা প্রমাণ মিলল গত দু’দিন ধরা চলা প্রতিবন্ধীদের ক্রীড়া আসরে। জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতি এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এবারের আসরের সেম্লাগানটা ছিল—‘ক্রীড়া ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার।’ ছয় বছর বয়স থেকে ২৩ ঊর্ধ্ব বয়সী বুদ্ধি, শ্রবণ, বাক, দৃষ্টি এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী—এই চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে গোটা দেশের প্রায় পাঁচ শতাধিক ছেলেমেয়ে দ’ুদিনব্যাপী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। উত্সবে-আমেজে মাতিয়ে রেখেছিল তারা পুরো প্রতিযোগিতা। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলার দেখা মেলেনি।
সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়ানো। ইভেন্ট শেষ হতেই পুরস্কার নেয়ার জন্য মঞ্চের কাছে সুশৃঙ্খলভাবে এসে হাজির হওয়া। স্যালুট জানিয়ে অতিথির কাছ থেকে পুরস্কার নেয়া। হাসিমুখে আশপাশের সবাইকে নিজের করে নেয়া। শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করার যে অদম্য সাহস ও প্রতিজ্ঞা এসব ক্রীড়াবিদের চোখেমুখে দেখা গেছে, সেটা যদি পুরো বাংলাদেশের ছবি হতো!
জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতির মহাসচিব এমএ বাতেন এই অভিযোগটা লুকিয়ে রাখলেন না—‘দেখুন, সরকার শুধু মুখে আমাদের সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলে কিন্তু সেটা যে কবে বাস্তবে হবে! সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার
হলো, দেশের শতকরা ১০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। অথচ এই প্রতিবন্ধীদের জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ নেই। আমরা শুধু আশ্বাসের ওপরই আছি। অর্থমন্ত্রী স্বয়ং কিছুদিন আগে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে আমাদের জন্য কোটি টাকার বাজেট দিতে বলেছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কোনো নড়াচড়া নেই। প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন স্কুলে ভর্তির জন্য সমান অধিকারের কথা বলেছেন। কিন্তু সেটা কতটুকু বাস্তবায়ন হয় সেটাই আসল ব্যাপার।’
প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতির সভাপতি মেজর মোহাম্মদ ইয়াদ আলী ফকিরও (অব.) বললেন—‘ক্রীড়া বা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে আমরা কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা পাই না। ব্যক্তিগতভাবে আসা কিছু দান-অনুদান এবং এনজিও প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন এইডের সহায়তায় আমরা প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতির ব্যয় নির্বাহ করি। আমরা চাই, দেশের এসব প্রতিবন্ধীও যাতে সমান অধিকার নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। এদের হয়তো একটা ইন্দ্রিয়শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু অন্যসব ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগিয়ে এসব প্রতিবন্ধী সমাজে যে কোনো লড়াইয়ে জেতার ক্ষমতা রাখে। এই প্রতিবন্ধীরা আমাদের স্পেশাল অলিম্পিক থেকে ৩২টি স্বর্ণপদক উপহার দিয়েছে। দেশের জন্য অনেক সম্মান এনেছে ওরা। এখন তো প্রতিদান দেয়ার সময়। আমরা সবাই মিলে কি তাদের সামান্য সহযোগিতা-সমর্থন দিতে পারি না?’
—এটা খুব কি বেশি কিছু চাওয়া?
প্রতিবন্ধীদের বিশ্বজয়ের গল্প সবারই জানা। শুধু একটু যত্ন ও মমতার হাত বাড়িয়ে দিলেই তারা সমাজের অন্যসব মানুষের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে! পারে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষদেরও ছাড়িয়ে যেতে—স্টিফেন হকিংই হতে পারেন এখানে বড় উদাহরণ! শারীরিক প্রতিবন্ধী এই বিজ্ঞানী যে হুইল চেয়ারে বসেই চলতি বিশ্বের সবচেয়ে জ্ঞানী বিজ্ঞানী!
—ওমা, এই মেয়ে যে অটোগ্রাফ চায়!
দুই পাশে মাথা নেড়ে সায় দিল। কলম খুলে রেখার হাতে নিজের নাম লিখে দিতেই সেকি খুশি সে! চোখেমুখে আনন্দের ছটা। বিশাল কিছু একটা পাওয়ার উল্লাস সেখানে। ডায়াসের পাশে দাঁড়ানো বন্ধুদের হাতটা নাড়িয়ে দেখাতে লাগল সে।
—তুমি কোত্থেকে এসেছ?
প্রশ্নটা শুনে গলার সঙ্গে ঝোলানো পরিচয়পত্র সামনে মেলে ধরল। সেখানে তার নাম লেখা— তাসলিমা খাতুন রেখা। বয়স ৯। ঠিকানা—কুষ্টিয়া। রেখা কথা বলতে পারে না। শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী সে। মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের মাঠের পশ্চিমদিকের কিছু অংশ শামিয়ানা দিয়ে ঘেরা। অতিথিদের বসার জায়গা সেটা। সেখানেই রেখার অভিভাবিকা জানালেন—‘ও কথা বলতে পারে না। শুনতেও পারে না। কিন্তু অনেক বুদ্ধি ওর। সামান্য উশারায় অনেক কিছু বুঝতে পারে। এখানে এই প্রতিযোগিতায় সে দুটো পুরস্কার জিতেছে। আমার বিশ্বাস, সহযোগিতা ও সামান্য সমর্থন পেলে সে অনেক বড় কিছু করতে পারবে।’
ঠিক একই বিশ্বাস ঝরল বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেটার হাফিজুর রহমান বুলেটের গলায়ও—‘যে কোনো লক্ষ্য অর্জনে বয়স ও প্রতিবন্ধিতা কোনো বাধা নয়। চাই অনুপ্রেরণা, চাই সহযোগিতা। আমরা মানুষের কাছ থেকে শুধু সামান্য এই দুটো বিষয় চাই। এই অনুপ্রেরণা এবং সঙ্গে সহযোগিতা পেলে যে কোনো প্রতিবন্ধী মানুষ উন্নয়নের মূলধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে দেশের আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।’
ছেলেদের বল নিক্ষেপে প্রথম স্থান পাওয়া শফিকুল হুইল চেয়ারে বসে রঙিন কাগজে মোড়ানো পুরস্কারের প্যাকেট হাতে বসেছিল। কাছে যেতেই কথার ঝাঁপি খুলে দিল ১৭ বছর বয়সী শফিকুল—‘জানেন, আমি আগেরদিনও একটা পুরস্কার জিতেছি। আমি একদিন আরও বড় ফার্স্ট দিব।’ শফিকুল নিজ পায়ে হাঁটতে পারে না। যখন থেকে হুঁশ হয়েছে সঙ্গী তার হুইল চেয়ার। জন্মই নিয়েছে সে পোলিও রোগ নিয়ে। কোমরের নিচ থেকে দুটো পা অসাড় তার। শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ বেশ সবল। কিন্তু দুটো পা-ই অস্বাভাবিক রকম চিকন। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন—শফিকুল কোনোদিন নিজের পায়ে হাঁটতে পারবে না। কঠিন সত্যটা শফিকুল নিজেও জানে। তবে দুঃখ পায় যখন কেউ তার সঙ্গে তার এই ‘অসুখ’ নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করে। শফিকুল বলছিল—‘গ্রামে অনেকে এসব নিয়ে আমার সঙ্গে শয়তানি করত। উল্লা-পাল্টা কথা বলত। তখন আমার অনেক খারাপ লাগত। মাঝে মাঝে কাঁদতাম। কিন্তু কাউকে চোখের পানি দেখাতাম না। তবে সাভারের সিআরপিতে আসার পর থেকে আমি নতুনভাবে বাঁচতে শিখেছি। এখানে আমি ইলেকট্রিকের ও মোবাইল ফোন মেরামতের কাজ শিখছি।’ সামনের দিনে নিজের স্বপ্নের কথা জানাচ্ছিল শফিকুল—‘এই কাজ শিখে আমি একটা দোকান দিতে চাই। সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।’
শফিকুলের শেষের কথায় জেদ মিলল। নিজেকে প্রমাণ করার জেদ। অদৃশ্য কারো সঙ্গে জেতার একটা জেদ যেন!
কুষ্টিয়ার কাকলির বয়স যখন চার তখন থেকেই সে নানীর কাছে। বাবা-মা নিতে এলেও কাকলি নানীর বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে। যেতে চায় না। কাকলিও শ্রবণ এবং বাকপ্রতিবন্দ্বী। কিন্তু দারুণ গুণবতী। সে কথাই শোনাচ্ছিলেন তার নানী লিলি বেগম—‘সেলাইয়ের কাজ, বাসার কাজ, রান্নাবান্না—সব কাজ পারে কাকলি। অনেক কষ্ট করে ওকে মানুষ করেছি। ওর বয়স এখন ষোল। আমি ওকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার জীবন আর কতদিন। আমি চাই ও নিজে চলা শিখুক।’ কুষ্টিয়ার প্রতিবন্ধী স্কুলের ভালছাত্রী কাকলি খেলাধুলায়ও চোস্ত। এবারের প্রতিযোগিতায় দৌড়ে প্রথম হয়েছে সে। সামনের অনাগত ‘জীবনের দৌড়েও’ কাকলি এখন সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। আর সেই লড়াইয়ে জিততে করুণা বা দয়া-দাক্ষিণ্য নয়, চায় সে সামান্য সহযোগিতা-সহমর্মিতা।
রেখা, বুলেট, শফিকুল ও কাকলি—সমাজ এদের সবাইকে চেনে প্রতিবন্ধী হিসেবে। এই প্রতিবন্ধীরা যে ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশের হয়ে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে, তারই একটা প্রমাণ মিলল গত দু’দিন ধরা চলা প্রতিবন্ধীদের ক্রীড়া আসরে। জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতি এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এবারের আসরের সেম্লাগানটা ছিল—‘ক্রীড়া ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার।’ ছয় বছর বয়স থেকে ২৩ ঊর্ধ্ব বয়সী বুদ্ধি, শ্রবণ, বাক, দৃষ্টি এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী—এই চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে গোটা দেশের প্রায় পাঁচ শতাধিক ছেলেমেয়ে দ’ুদিনব্যাপী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। উত্সবে-আমেজে মাতিয়ে রেখেছিল তারা পুরো প্রতিযোগিতা। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলার দেখা মেলেনি।
সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়ানো। ইভেন্ট শেষ হতেই পুরস্কার নেয়ার জন্য মঞ্চের কাছে সুশৃঙ্খলভাবে এসে হাজির হওয়া। স্যালুট জানিয়ে অতিথির কাছ থেকে পুরস্কার নেয়া। হাসিমুখে আশপাশের সবাইকে নিজের করে নেয়া। শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করার যে অদম্য সাহস ও প্রতিজ্ঞা এসব ক্রীড়াবিদের চোখেমুখে দেখা গেছে, সেটা যদি পুরো বাংলাদেশের ছবি হতো!
জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতির মহাসচিব এমএ বাতেন এই অভিযোগটা লুকিয়ে রাখলেন না—‘দেখুন, সরকার শুধু মুখে আমাদের সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলে কিন্তু সেটা যে কবে বাস্তবে হবে! সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার
হলো, দেশের শতকরা ১০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। অথচ এই প্রতিবন্ধীদের জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ নেই। আমরা শুধু আশ্বাসের ওপরই আছি। অর্থমন্ত্রী স্বয়ং কিছুদিন আগে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে আমাদের জন্য কোটি টাকার বাজেট দিতে বলেছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কোনো নড়াচড়া নেই। প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন স্কুলে ভর্তির জন্য সমান অধিকারের কথা বলেছেন। কিন্তু সেটা কতটুকু বাস্তবায়ন হয় সেটাই আসল ব্যাপার।’
প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতির সভাপতি মেজর মোহাম্মদ ইয়াদ আলী ফকিরও (অব.) বললেন—‘ক্রীড়া বা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে আমরা কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা পাই না। ব্যক্তিগতভাবে আসা কিছু দান-অনুদান এবং এনজিও প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন এইডের সহায়তায় আমরা প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতির ব্যয় নির্বাহ করি। আমরা চাই, দেশের এসব প্রতিবন্ধীও যাতে সমান অধিকার নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। এদের হয়তো একটা ইন্দ্রিয়শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু অন্যসব ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগিয়ে এসব প্রতিবন্ধী সমাজে যে কোনো লড়াইয়ে জেতার ক্ষমতা রাখে। এই প্রতিবন্ধীরা আমাদের স্পেশাল অলিম্পিক থেকে ৩২টি স্বর্ণপদক উপহার দিয়েছে। দেশের জন্য অনেক সম্মান এনেছে ওরা। এখন তো প্রতিদান দেয়ার সময়। আমরা সবাই মিলে কি তাদের সামান্য সহযোগিতা-সমর্থন দিতে পারি না?’
—এটা খুব কি বেশি কিছু চাওয়া?
প্রতিবন্ধীদের বিশ্বজয়ের গল্প সবারই জানা। শুধু একটু যত্ন ও মমতার হাত বাড়িয়ে দিলেই তারা সমাজের অন্যসব মানুষের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে! পারে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষদেরও ছাড়িয়ে যেতে—স্টিফেন হকিংই হতে পারেন এখানে বড় উদাহরণ! শারীরিক প্রতিবন্ধী এই বিজ্ঞানী যে হুইল চেয়ারে বসেই চলতি বিশ্বের সবচেয়ে জ্ঞানী বিজ্ঞানী!