স্থবিরতা কেটে যাক


স্বাগত ইংরেজি নতুন বছর ২০১০। নতুন প্রত্যাশায় আজ উদীত হয়েছে নতুন বছরের সূর্য। সব ধরনের স্থবিরতা কাটিয়ে নতুন বছর সবার জীবনে বয়ে আনুন অনাবিল আনন্দ। দেশে ফিরে আসুক শান্তি, সমৃদ্ধি, স্বস্তি ও গতিময়তা।
কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি, অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক। মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা।’ এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরা বলতে চাই নতুন বছরে কেটে যাক সব ধরনের স্থবিরতা। যে স্থবিরতা গ্রাস করেছে আমাদের অর্থনীতি, বিনিয়োগ, রাজনীতি, সংসদ, প্রশাসন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে। সর্বোপরি আমাদের সার্বিক জনজীবনকে।
বিতর্কিত হলেও একটি নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক শাসনের আকাঙ্ক্ষায় ২০০৯ সালে যে ব্যাপক প্রত্যাশা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার যাত্রা শুরু করেছিল, বছর গড়িয়ে সে প্রত্যাশার খুব কম অংশই পূরণ হয়েছে। কিন্তু নতুন বছরে দেশের মানুষের প্রত্যাশা সব হতাশা, সব গ্লানি কাটিয়ে উঠে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সচল হবে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংসদ, প্রশাসন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বলেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন হবে নতুন বছরে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ দেশের বর্তমান খারাপ বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে এর কোনো বিকল্প নেই। বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, সরকারি দলের নেতাদের টেন্ডারবাজি বন্ধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাও হবে নতুন বছরে সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বছরশেষে এসে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগাম যেন কোনোভাবেই টেনে ধরে রাখা যাচ্ছে না। অস্থিতিশীল বাজারকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনাও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতি ঘরে একজনকে চাকরি দেয়ার বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন দূরের কথা, গেল বছরে সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানের অবস্থা খুবই নাজুক। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিও সম্ভব হবে না। আইনশৃঙ্খলার সার্বিক উন্নয়নসহ ক্রসফায়ারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করাও সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালঞ্জ।
নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিয়ে প্রধান বিরোধী দল যে আশার সঞ্চার করেছিল, প্রথম অধিবেশনেই সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো গঠনের মধ্য দিয়ে যে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপতি হয়েছিল, সেটাকে ধরে রাখতে বিরোধী দলকে সংসদে ফিরিয়ে নেয়া এবং সংসদকে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে নতুন বছরে অপেক্ষা করছে। বিরোধী দলকে জন দাবি বাস্তবায়নে রাজপথে আন্দোলনের দিকে ঠেলে না দিয়ে সংসদের ভেতরে রেখে যাতে সেখানেই সব আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়, সে ব্যাপারে নতুন বছরে সংশ্লিষ্টারা সক্রিয় হবেন বলে ব্যাপক প্রত্যাশা রয়েছে জনমনে।
মন্ত্রিসভায় নতুন মুখের চমক নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলেও গত এক বছরে সরকার কোনো চমক দেখাতে পারেনি। বরং বছরশেষে সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ড নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মন্ত্রীদের নানান বক্তব্য বছরজুড়েই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বছরশেষে মত্স্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়সহ সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতির অভিযোগের সঠিক জবাব ও নিরপেক্ষ আইনগত তদন্তের মাধ্যমে এর সুরাহা করতে হবে সরকারকে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আপিল বিভাগের রায়কে সরকার গত বছরে তাদের অর্জনের শীর্ষে রাখলেও জনগণ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য দেখতে চায়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায়, দেশের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের ভূমিকার মূল্যায়ন করতে চায়। টিপাইমুখে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ভারতের বাঁধ নির্মাণ এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন চুক্তি, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, ট্রানজিট, এশিয়ান হাইওয়ের নামে ভারতকে করিডোর প্রদান, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধসহ বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ জানুয়ারি ভারত সফরে গিয়ে এসব বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেন, সেদিকে দেশবাসীর দৃষ্টি রয়েছে। নতুন বছরে দেশের মানুষের প্রত্যাশা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কিছু প্রধানমন্ত্রী করবেন না।
প্রশাসনে দফায় দফায় ব্যাপক রদবদল, ওএসডি ও চাকরিচ্যুতির মধ্য দিয়ে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা সামাল দিতে না পারলে নতুন বছরেও প্রাশাসনিক স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। অবসরে যাওয়া সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের যেভাবে দলীয় বিবেচনায় দু’তিনটি পর্যন্ত প্রমোশন দিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল কিংবা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নতুন করে যে বৈষম্য ও ক্ষোভের জন্ম দেয়া হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে সমস্যা থেকেই যাবে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর দলীয় ক্যাডারদের চাপ কমাতে না পারলে মাঠ পর্যায়েও অবস্থার উন্নতি হবে না। এসব বিষয়ে নজর দিয়ে এগুলোর সুরাহা করাও নতুন বছরে সরকারের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা ও লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মতো যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে। রাজনৈতিক মামলা-মোকদ্দমা দলীয় বিবেচনায় প্রত্যাহার না করে দলমতের ঊর্ধ্ব উঠে একই নীতি গ্রহণ সরকার করবে বলে সবার প্রত্যাশা। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা কিংবা ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার মতো মামলাগুলো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পুনঃতদন্তের নামে মানুষকে হয়রানির পথ সরকার পরিহার করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা হবে বলে দেশের মানুষের প্রত্যাশা। এছাড়াও সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে বঙ্গবন্ধু হ্যতাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা।
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাম পরিবর্তনের যে সংস্কৃতি সেটা থেকে বর্তমান সরকার মুক্ত হতে পারেনি। বরং জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব স্থাপনা থেকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামসহ বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এ থেকে সরকারকে মুক্ত হতে হবে।
সাংবাদিককের হয়রানি ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়ে সরকার যে সমালোচনার মধ্যে পড়েছে, সেটা থেকে মুক্ত হতে নতুন বছরে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। মিডিয়ার সঙ্গে লড়াই করে, অন্যায়ভাবে কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে কোনো সরকারই সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমান সরকারও পারবে না, ইতিহাসের এই শিক্ষা না নিলে সরকারকে এর খেসারত দিতে হবে বড় আকারে।
নির্বাচনের পর প্রথম বছর বলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রু্রতি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুতের অব্যাহত লোডশেডিং কিংবা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার না হওয়াসহ সরাসরি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ দেশের মানুষ গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে। প্রথম বছর বলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসেনি। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হলে, সরকারের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় তারা সক্রিয় না হলে, এর মাশুল সরকারকে দিতে হবে। নতুন বছরে জনগণের প্রত্যাশা থাকবে সরকার অন্তত জনগণের কাছে দেয়া তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করুক। সব স্থবিরতা কেটে গিয়ে দেশ আবার সচল হয়ে উঠুক। গণতন্ত্র পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাক। সচল হয়ে উঠুক সংসদ ও প্রশাসন। উন্নয়ন ও উত্পাদনে নতুন গতি সঞ্চারিত হোক।