
২০০০ সালে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ছিল খুবই দুর্বল। খুব অল্পসংখ্যক ব্যবহারকারী তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পেত। ১০ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যদিও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি।
গত দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে মোবাইল ফোন সেবার ক্ষেত্রে।১০ বছর আগে এ ব্যাপারটি প্রায় অকল্পনীয় ছিল। বর্তমানে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মোবাইল ফোন বহন করে এবং দেশের যেকোনো জায়গা থেকে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে ফোনসেটের দামও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভেতর চলে এসেছে। গত দশকের শেষ বছর ২০০৯ সালে এসে দেশের সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে, যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা অপ্রতুল। ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের যে কার্যক্রম সারা দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে, তাতে ল্যাপটপ কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ কম্পিউটারের ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছে। এর আগে তাদের অধিকাংশই হয় কম্পিউটারের নাম শোনেনি বা এই যন্ত্রটি দেখার সুযোগ পায়নি।প্রায় আট কোটি ভোটারের ছবি ও আঙুলের ছাপসহ যে তথ্যভাণ্ডার তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যতে শুধু নির্বাচন নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে একটি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের চেয়ে উন্নত অনেক দেশ এমন কার্যক্রমে সাফল্যের মুখ দেখেনি।
গত এক দশকে অনেক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই মূল উদ্যোক্তা কম্পিউটার-সংক্রান্ত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণ।
২০০০ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাওয়া পেশাজীবী বা উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিল কয়েক শ মাত্র। এখন সে সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং সফটওয়্যার শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য। তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সমগ্র জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটি তরুণ প্রজন্মকে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে উত্সাহী করেছে।
মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তারহীন প্রযুক্তির মাধ্যমে সারা দেশে ইন্টারনেটের বিস্তার ঘটিয়েছে। কিন্তু এর গতি অনেক ধীর এবং খরচও বেশি। গত কয়েক বছরে মোবাইল ফোনের বহুমুখী ব্যবহার বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ভর্তি এবং পরীক্ষার ফলাফল মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সময় বেঁচেছে এবং ঝামেলা কমেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান অংশ হবে সরকারের কর্মকাণ্ডে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার, যাকে এক কথায় ই-গভর্নেন্স বা ই-সরকার বলা যায়। ২০০৯ সালে সরকারের একটি উন্নত নকশার ওয়েব পোর্টাল চালু হয়েছে এবং এতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এতে এখন অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট আরও তথ্যসমৃদ্ধ করা হয়েছে। তবে এখনো অনেক বিভাগ এবং সরকারি দপ্তরের ওয়েবসাইটের লিংক পোর্টাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া সরকারি অফিসগুলোতে তথ্য অনুসন্ধান করে ই-মেইল পাঠালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার উত্তর পাওয়া যায় না।
২০০৬ সালে প্রণীত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের (আইটি অ্যাক্ট) সংশোধন হয়েছে গত বছর। অতীতের আইনের একটি দুর্বল ধারার কারণে ডিজিটাল স্বাক্ষর কর্তৃপক্ষ গঠনে যে বাধা ছিল, সেটি সংশোধনীর মাধ্যমে দূর হয়েছে।বছরের শেষের দিকে এর কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ডিজিটাল স্বাক্ষরের প্রচলন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলেক্টেনিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাঠানো তথ্যের আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বয়ংক্রিয় ক্লিয়ারিং হাউসের মাধ্যমে চেক প্রক্রিয়াকরণও অনেক দ্রুতগতিতে করা সম্ভব হচ্ছে।
২০০৯ বাংলাদেশের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা স্বয়ংক্রিয় আঙুলের ছাপ শনাক্তকারী প্রযুক্তি—অটোমেটেড ফিঙারপ্রিন্ট আইডেনটিফিকেশন সিস্টেমকে (এএফআইসি) যুক্তরাষ্ট্রের এনআইএসটি সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং দ্রুত গতিসম্পন্ন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ আসার ফলে স্কুল-কলেজে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ল্যাপটপ ও নেটবুক কম্পিউটার কিনছে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। ভিস্যাট নির্ভর ইন্টারনেট যোগাযোগ থেকে অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করুন। তথ্যপ্রযুক্তি মহাসড়কে সংযুক্তি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। গত বছরেই বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ইন্টারনেট ফি কমিয়েছে, যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একই খরচে বেশি ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে। টেলিসেন্টারের সংখ্যা প্রায় তিন হাজারে পৌঁছে গেছে, যার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে স্বাস্থ্য, কৃষিসংক্রান্ত তথ্যসহ নানা ধরনের সেবা দেওয়া যাচ্ছে। তরুণ শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও বুয়েট দলের ধারাবাহিক কৃতিত্ব বাংলাদেশের জন্য অনেক সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
২০১০ সালে প্রত্যাশা
২০১০ সালের মাধ্যমে আরেকটি দশকের শুরু হলো। এ দশকের শুরু থেকেই ই-গভর্নেন্স আরও বিস্তৃতি লাভ করবে, এ প্রত্যাশা করা যায়। দরকারি তথ্য জেনে চাহিদা মোতাবেক জনগণের কাছে সরবরাহ করা হবে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে একটি আন্তনেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যার ফলে সরকারি কার্যক্রমে গতি আসবে। ই-পেমেন্ট গেটওয়ে কার্যক্রম পূর্ণোদ্যমে শুরু করে ই-কমার্সের ব্যাপক প্রসার ঘটানো দরকার। তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা, যা গত বছর সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছে, তাতে যে ৩০৬টি স্বল্প-মধ্যম মেয়াদি পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন জোরেশোরে শুরু করতে হবে। মোট সংখ্যার ন্যূনতম ৫০ শতাংশমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা উচিত।মুক্ত সফটওয়্যারের ব্যাপক ব্যবহার শুরু এবং বাংলা ভাষায় একটি সর্বজন স্বীকৃত প্রমিত সংকেত (কোড) প্রণয়ন করা উচিত ২০১০ সালেই।এ বছর আরও প্রত্যাশা হলো—ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) ব্যবহারে এখনো যেসব বাধা আছে, সেগুলো দূর করে আরও কম খরচে ফোন করার সুযোগ সৃষ্টি করা।এ ছাড়া ওয়াইম্যাক্স সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি সহজলভ্য হবে। কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্কে বাস্তবায়নও এ বছর শুরু হবে বলে আশা করি।
4m- Prothom Alo